WELCOME TO NANDAIL NEWS - REFLECTION OF TIME - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ -সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ -সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি - স্বাগতম- নান্দাইল নিউজ - সময়ের প্রতিচ্ছবি

শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০১২

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে শহীদ হারুন

স্বীকৃতি মেলেনি ৪২ বছরেও


শাহ্ আলম ভূঁইয়া, নান্দাইল সংবাদদাতা
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

১. গৌরিপুরে শহীদ হারুন পার্ক ২. গৌরিপুর কলেজ ও নিচে শহীদ হারুনের চার ভাই
নান্দাইল(ময়মনসিংহ): লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীন দেশে আমরা কতটুকুই স্মরণ রেখেছি সেসব বীর শহীদদের অবদান। আমরা বড়ই আত্নভোলা আর অকৃতজ্ঞ জাতি-এমন অভিযোগ এক্ষেত্রে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক।

১৯৬৯ সালের আইয়ুব সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনে ২৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহের গৌরীপুরে প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন কলেজ পড়ুয়া টগবগে যুবক আব্দুল আজিজ ওরুফে হারুন। প্রিয় দেশমাতৃকার জন্য আত্নাহুতি দেয়ার ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও অধ্যাবধি স্বীকৃতি মেলেনি এ বীর সন্তানের। এখনো অরক্ষিত হারুনের স্মৃতি বিজড়িত স্থানটি।
৪৩তম  মৃত্যুবার্ষিকীতে ক্ষোভ জানিয়ে হারুনের পরিবার বাংলানিউজকে বলেছেন, একই আন্দোলনে ও একই সময়ে শহীদ হওয়া আসাদের মৃত্যুদিবস জন্য জাতীয় ভাবে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হলেও কেন হারুনের আত্নত্যাগের স্বীকৃতি দেয়া হবে না। কেন সরকারি ভাবে পালিত হবে না হারুনের মৃত্যুবার্ষিকী, রক্ষা করা হবে না তাঁর স্মৃতিচিহ্ন।   
নান্দাইল উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়নের ছামারুল্লা গ্রামের মিয়া বক্স সরকারের ছেলে হারুন। অভ্যুত্থানের সময় হারুন গৌরীপুর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতো সে।

সারা দেশে যখন গণ-আন্দোলন শুরু হয় তখন ঢাকায় ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। এ ঘটনায় সারা দেশের মতো  ময়মনসিংহের গৌরীপুর কলেজের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল।
১৯৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি। সারাদেশের মতো গৌরীপুরেও ৬ দফার দাবিতে আবালবৃদ্ধবণিতা তীব্র প্রতিবাদে মিছিল সহকারে রাস্তায় নেমে আসে। সকালে গৌরিপুর তথা বর্তমান পৌর শহরে সেই মিছিলের অগ্রভাগে অংশ অংশ নেয় তরুনরা। পুলিশের অস্ত্রের মুখেই চলছিল মিছিল। মিছিলকারীদের লক্ষ অভিন্ন- দাবি আদায়, অস্ত্রের ভয় তাদের কাছে তুচ্ছ। মিছিল চলাকালে হঠাত পুলিশের একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় ১৬ বছরের কলেজ ছাত্র হারুনের বুকে। ওই গুলি হারুনের বুক ছিদ্র করে গিয়ে বিধে একটি কাঁটাল গাছে । মুহুর্তেই প্রাণ হারাণ হারুন। তখনও গৌরীপুর থানা হয়নি, তাই গৌরীপুর পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মজিদ মল্লিকের নির্দেশে এক আনসার সদস্যের মাধ্যমে রিকশাযোগে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁড়িতে। পরে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে হারুনের লাশ নান্দাইলের ছামারুল্লা গ্রামে তার স্বজনদের হেফাজতে দেয়া হয়। পারিবারিক ভাবে হারুনকে সমাহিত করা হয় তার নিজ গ্রামেই। সেখানেই অন্তিম শয়নে শায়িত হন হারুন।
এলাকাবাসির উদ্যোগে সেই বছরই তার মৃত্যুর স্থানের পাশে সরকারি জমিটির নাম রাখা হয় হারুন পার্ক। হারুন শহীদ হওয়ার স্থানেও একটি বেদী তৈরী করেছিল তৎকালীন তরুণ ছাত্ররা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার ও তাদের এদেশিয় দোসররা শহীদ মিনার এবং হারুণের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন বেদীটিও ধ্বংস করে দেয়। আজও হারুণের নামে গড়ে তুলা পার্কটিতে তার নামফলক নির্মিত হয়নি। এ শহরে আসা বাহিরের মানুষজন জানতেও পারে না এ খোলা স্থানটির নাম কি। এমনটি বর্তমান প্রজন্মের সিংহভাগ মানুষ হারুন পার্ক চিনে ঠিকই কিন্তু জানে না এ পার্ক নামদারী খোলা স্থানটির সাথে জড়িত আছে গৌরবময় ’৬৯ সালের আন্দোলনের রক্তঝরা  ইতিহাস।
হারুনের সাথে মিছিলে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই অক্ষেপ করেন। হারুন তার তাজা প্রাণ দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনকে অমর করে রাখার অংশিদার। কিন্তু তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছুই করা হয়নি। তাদেরও দাবি হারুন পার্কের নাম ফলকসহ বর্তমান গৌরীপুর সরকারী কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হোক হারুনের নামে। সেই সাথে নান্দাইল সদর থেকে আঠারবাড়ি সড়কটির নামকরণ করা হোক হারুনের নামে ।

তৎকালীন গৌরীপুর কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি মোঃ ফজলুল হক (৬৫) বাংলানিউজকে জানান, ‘মিছিলের গুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমরা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। হারুন যেখানে শহীদ হয় সেই স্থানের পাশের ঘরের বাথরুমে আমি তখন অজ্ঞান হয়ে পরে আছি। জ্ঞান ফিরে দেখি হারুন শহীদ হয়েছে। তাকে এক আনসার রিকশাযোগে ফাঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে ফাঁড়ির দিকে ছুটে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ অস্ত্র তাক করে আমাদের দিকে মুভ করে। আমরা বাধ্য হয়ে ফিরে আসি। এর পর থেকে অদ্যাবধি আমি হারুনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হারুন পার্কের নামফলকসহ বর্তমান গৌরীপুর সরকারী কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করার দাবি জানিয়ে আসছি। এতে কর্তৃপক্ষের কোন ইতিবাচক মনোভাব আজও সম্ভব হয়নি।
এমনকি প্রতিবছর ২৭ জানুয়ারি আমার নিজ উদ্যোগে কয়েজনের সহযোগিতায় হারুনপার্কে শহীদ হারুন দিবস পালন করি। ক্ষমতার কাছাকাছি না থাকার কারণে আমি কিছুই করতে পারেনি। তবুও এই দিন এলে তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাই।’

গৌরীপুর  উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার আব্দুর রহিম (৬০) বাংলানিউজকে জানান, ‘১৯৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি গৌরীপুরের জন্য একটি গৌরবের দিন। ওইদিন গৌরীপুরের ছাত্রজনতা এগারো দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পথে নেমিছিল। পুলিশ বাহিনীর ববর্রোচিত হামলায় সেদিন নৃসংশভাবে শহীদ হয়েছিলেন গৌরীপুর কলেজের ছাত্র হারুন। আমরা হারুণের স্মৃতিরক্ষার্থে বর্তমান গৌরীপুর সরকারী কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণের দাবি জানাচ্ছি।’             

তৎকালীন ছাত্রনেতা মোঃ আঃ ছাত্তার (৬২)বাংলানিউজকে জানান, ‘গৌরীপুরের মতো তৃণমূল পর্যায়ে এগারো দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামে নিজের জীবন দিয়ে আমাদের শুধু ঋণীই করে গেলেন। আমরা তাঁর জন্য কিছুই করতে পারিনি। আজ তাঁর অবদানও ভুলে যেতে বসেছে গৌরীপুরবাসী।’

এদিকে শহীদ হারুনের পরিবার সূত্রে জানা যায়, মোঃ মিয়া বক্স সরকারের  ৬ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে হারুন ছিল তৃতীয়। মেধাবী থাকায় অভিভাবকরা তাঁকে  ভর্তি করে দেন গৌরীপুর কলেজে।
নান্দাইল-আঠারবাড়ি সড়কের পাশেই শহীদ আব্দুল আজিজ হারুন চির নিদ্রায় শুয়ে আছেন। জরাজীর্ণ কবরটি এলাকার লোকজনের সহায়তায় কিছু ইট দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হলেও এখন আর কেহ স্মরণ করে না। হারুনদের ৬ ভাইয়ের মধ্যে জীবিত তিন জন হলেন, মোঃ আব্দুল হামিদ, আব্দুর রশিদ ও শফিকুল আলম চাঁন মিয়া। মৃত দুইজন হলেন, আব্দুল মাজিদ ও আব্দুল গনি। তিন বোনের মধ্যে আনোয়ারা খাতুন নামে একজন জীবিত ও অপর দুই বোন আমেনা খাতুন ও আছিয়া মারা গেছেন।

হারুনের ছোট ভাই শফিকুল আলম চাঁন মিয়া (৫৪)বাংলানিউজকে জানান, ‘সে সময় তিনি স্থানীয় স্কুলের পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র ছিলেন। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে গৌরিপুর গেলেও কোন পরিচয় না দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন পুলিশ লাশ অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। পরে তিন দিন পর ময়মনসিংহ থেকে মুচলেখা দিয়ে ভাইয়ের লাশ নিয়ে নান্দাইলে আসি। তখন পুলিশি প্রহড়ায় লাশ দাফন করা হয়।

গৌরিপুর কলেজে পড়া অবস্থায় হারুনের সহপাঠি নান্দাইলের কূল ধূরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ ইছহাক আকন্দ(৬৮) জানান, আন্দোলন শুরু হলে হারুন কলেজের শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেয়। ২৭ জানুয়ারি পুলিশের দেওয়া ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয় হারুন। তার এই সাহসি পদক্ষেপে অনেকে ভয় পেলেও সে মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়।
হারুনের বড় ভাই আব্দুর রশিদ (৬৫) বাংলানিউজকে বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পরদিন ঢাকায় আসাদসহ আরো কয়েকজন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। কিন্তু জাতীয় ভাবে আসাদের মৃত্যুর ঘটনাটি স্থান পেলেও আমার ভাইয়ের খবর কেউ রাখেনি। ছেলের আত্নত্যাগের স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা নিয়েই বাবা মিয়া বক্স সরকার এবং মা খাতুন্নেনেছা  ইহলোক ত্যাগ করেছেন।’

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, ২৮ জানুয়ারি, ২০১২