বেদেদের সংগ্রামী জীবন যাপন
নান্দাইল নিউজ ডেক্স:
'এই মাজা টানি, বাতের বিষ নামাই'। লাগব নাকি। এভাবেই বলতে বলতে চললেন চল্লিশোর্ধ্ব এক বেদে। এক কাঁধে একটি ব্যাগ। অন্য কাঁধে কাপড় দিয়ে
ঝুলিয়ে রাখা একটি বাচ্চা। হাতে একটি ছোট্ট কাঠের সিঙ্গা। কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ক্ষ্যাপা
সুরে বলে উঠলেন-ওই মিয়া নাম দিয়া কাম কি? আগে দশটা ট্যাকা (টাকা) দিন। পরে নাম কমু (বলব)। টাকা বের করে দিতেই নামটা গল গল করে বলে দিল
'হামার নাম মর্জিনা'। থাকেন কোথায়। মর্জিনার সহজ-সরল উত্তর। মেঘনা নদীর পাড়ে। ওই দ্যাহেন (দেখেন) এখানে দাঁড়িয়ে নৌকা দেখা
যায়। ওখানেই বাইদ্যারা
(বেদে) বাস করি।
মর্জিনার মতো আরও অনেক বেদে আছেন যারা এভাবেই
রাস্তায় রাস্তায়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ, সাপের খেলা দেখিয়ে
জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষ এখন আর ঝাড়ফুঁক,
কবচ-তাবিজে বিশ্বাসী নয়। তাই এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় বেদেদের। বেঁচে থাকার তাগিদে
তারা এ পেশাকেই আকড়ে ধরে আছেন। রোগ-শোক তাদের নিত্যসঙ্গী। তাবিজ-কবচই তাদের একমাত্র চিকিৎসা। আর শিক্ষা কি তা তারা
এখনো ঠিকমতো বোঝেন না।
বেদেদের জীবনযাত্রা :
ভবঘুরে
জীবন বেদেদের। নৌকায় নৌকায় এখানে ওখানে গিয়ে জীবনযাপন করে। তাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। সাপ খেলা দেখিয়ে আর
তাবিজ-কবচ বিক্রি করে চলে তাদের জীবিকা। মেঘনা নদীর চঞ্চল স্রোতধারা থেকে একটি শাখানদী বেরিয়ে এসে সোনারগাঁওয়ের
ভাটিবন্দর রঘুভাঙ্গা এলাকায়। এখানে নৌকার ওপর বসতি স্থাপন করেছে বেদে সম্প্রদায়। এখানে রয়েছে ১২টি বেদের
নৌকা। তারা এখানে রয়েছে প্রায়
এক বছর যাবৎ।
বেদে পল্লীর জাছু (৩০) বললেন, এখন মানুষ আর সাপের খেলা দেখতে চায় না। সাপ দিয়ে ভয় দ্যাহাইয়া (দেখিয়ে) ট্যাহা (টাকা)
পয়সা আনি।
আপনার সাপ দিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা আনেন কেন?
এই প্রশ্নের জবাবে সুমাইয়া বললেন, তা নইলে (না হলে) দেবে না। এ বেদে পল্লীর আরেকজন মহুয়া বললেন, হামার (আমরা) কি করি, কি আই তা দ্যাহনের
(দেখার) মানুষ কই (কোথায়)। আমাদের জীবন আর চলে না। ঈশ্বরও বুঝি আমাদের দিকে আর খেয়াল রাখতে পারছেন
না। সাত/আট বছরের এক বেদে
শিশু এ প্রতিবেদকের কাছে এসে বলল, স্যার, আপনি ছবি তুলেন ক্যান (কেন)। আমাগো কোনো উপকার হবো (হবে)। নাম জিজ্ঞাসা করতেই
বলল, হাসি। সত্যিই হাসির মুখে যেন হাসি লেগে আছে। স্কুলে যাও কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে হাসি
একটু ভেবে বলল, হামারা (আমরা) খাইতে (খেতে) পারি না,
পরনের কাপড় জোটে না, স্কুলে যাব ক্যামনে। পড়ালেখা কইরা (করে) আমরা কি হরমু (করব), আমাদের সবাই ঘেন্না (ঘৃণা) করে।
বেদে সরদার মোতালিব বলেন, আমাদের ছবি তুলে লাভ কি? অনেক সাংবাদিক এসে ছবি তুলে নিয়ে যায়। আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। কেউ আমাদের খোঁজ খবর নেয় না। আমরা নিচু জাত বলে
সবাই ঘৃণা করে।
পুরনো নীতি অনুযায়ী এখনো চলছে বেদেদের বিয়ে। বিয়ের আগ মুহূর্তে
বরকে গাছের মগডালে উঠিয়ে কনেকে গাছের নিচে রাখা হয়। এ সময় বর গাছের উপর থেকে চিৎকার করে কনেকে
বলে আমি গাছ থেকে পড়ে মারা গেলাম। তখন কনে উচ্চৈঃস্বরে বরকে গাছ থেকে নেমে আসতে বলে। তুমি গাছ থেকে পড়ে
মরে (মারা) যেও না। অমি তোমাকে সারাজীবন খেটে খাওয়াব। তখনই বর গাছ থেকে নেমে আসে। এই হলো বেদেদের বিচিত্র বিয়ে। তবে তাদের বিয়েতে এখনো
যৌতুক প্রথা চালু রয়েছে। কনে পক্ষকে বর পক্ষ যৌতুক দিতে হয়। বিয়ের পরেই নববধূ নেমে পড়েন জীবিকার সন্ধানে। একপ্রান্ত থেকে অন্য
প্রান্তে, বিরামহীন ছুটে চলা অন্নের সন্ধানে। আর স্বামী থাকেন নৌকায়। তবে তাদের বিয়ে নিজেদের
মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখনো আদিমকালের মতোই তাদের বাল্যবিয়ের প্রচলন রয়েছে। মেয়ের ভরণপোষণের অভাবে তাড়াতাড়ি পাত্রস্থ
করেন। যে বয়সে তাদের বই-খাতা
নিয়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা তখন তারা স্বামীর ঘর করেন। ১৩-১৪ বছর বয়সেই সন্তানের মা হন। ভোগেন অপুষ্টিতে। দুই সন্তানের জননী
রাকিয়া (১৭) বললেন, আমার ১৪ বছর বয়সে বিয়া অইছে (হয়েছে)। মা-বাবা ভরণপোষণের
অভাবে বিয়া দিছে। আমার স্বামী আরেকটা বিয়া করছে।
অশিক্ষা তাদের জীবনকে এখনো আকড়ে ধরে আছে। শিক্ষা কি তারা বলতে
পারে না। মনে হয় তারা এখনো আদিম যুগে বসবাস করছে। আসলে মাটিতে দখল নেই বলেই তাদের জীবন নদীতে ভাসমান। ভাটিবন্দর রঘুভাঙ্গায়
মেঘনা নদীতে মোট ১২টি নৌকার পাশাপাশি রেখে সংসার পেতেছে বেশ কিছু বেদে। এ সময় তাদের ভেতর শিক্ষার
আলো ছড়িয়ে দিতে আসেন স্থানীয় একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সুবর্ণগ্রাম নামে এ
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা তরুণ ও শিক্ষাদানপ্রয়াসী শায়েদ কায়েস কয়েকটি বেদে পরিবারে সদস্যদের
সঙ্গে কথা বললেন। তাদের বুঝালেন, সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোটা খুব জরুরি। তাদের স্কুলে পাঠানো
বাবা-মা হিসেবে দায়িত্ব। বেদেদের কেউই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত
করতে তেমন উৎসাহ দেখালেন না। তবে শাহেদ কায়েস থামলেন না। তিনি ভাটিবন্দর রঘুভাঙ্গায় বেদে বহরের ওপর
প্রতিষ্ঠা করলেন 'বেদেবহর পাঠশালা'। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, একটি নৌকার ছইয়ে বেদেবহর ভাসমান পাঠশালার একটি সাইনবোর্ড লাগানো। আর নৌকার পাটাতনের
উপরের দিকে কাঠের তকতা বিছানো। তার উপরে বসে ১৬ জন বেদেশিশু শিক্ষিকার কাছ থেকে সমস্বরে বই
থেকে বাংলা ভাষা পাঠগ্রহণ করছে। এখানে ১৬ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেন দুজন শিক্ষক।
এ শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈতনিক। শিক্ষিকা হেমা আক্তার
বলেন, বাংলা ভাষায় শিক্ষা শেষ হলে আমি তাদের ইংরেজি
পাঠ শিখাই, শেখাই অঙ্কের সরল পাঠ, সংখ্যা গণনা, নামতা ও হিসাব
নিকাশ, যেন তারা জীবনের পথটা একজন বুঝবান মানুষের
মতো ঠিকঠাক বুঝে শুনে পাড়ি দিতে পারে। এ ব্যাপারে শাহেদ কায়েস
জানান, বেদেবহরের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করতে
পারলেই আমার পরিশ্রম সার্থক হবে। সোনারগাঁও উপজেলা শিক্ষা অফিসার নজরুল ইসলাম জানান, শুনেছি শাহেদ কায়েস নামের এক তরুণ বেদেবহরের ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত
করার জন্য চেষ্টা করছেন।
(সূত্র- বাংলাদেশ প্রতিদিন)